শিক্ষা হোক কর্মমুখী
মোঃ জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (টিএন্ডআইবি)
নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমী (ওটিএ)
মহাসচিব, ব্রাজিল-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিবিসিসিআই)
শিক্ষা হলো সেই ভিত্তি যার উপর একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। এটি মানুষকে নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন করতে, চিন্তাশক্তি গঠনে, সহানুভূতিশীল ও সুশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। শিক্ষা সমাজের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়।
বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা এখনও জীবনের উন্নতির সোনার চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু যখন শিক্ষা বাস্তব জীবনের প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন তার আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪০% স্নাতক বেকার অথবা স্বল্প-উপার্জনকারী, যা শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শ্রমবাজারের চাহিদার মধ্যে বড় এক ব্যবধানের ইঙ্গিত দেয়।
আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা মুখস্থনির্ভর ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের দিকে বেশি ঝুঁকে রয়েছে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে একটি দিকহীন প্রজন্ম, যারা ডিগ্রি পেলেও জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য খুঁজে পায় না এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ব্যর্থ হয়।
শিক্ষা ও জীবিকার সম্পর্ক
বাংলাদেশে প্রায় ৮৫% মানুষ নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২২)। এসব পরিবারের জন্য সন্তানের শিক্ষা একটি বড় বিনিয়োগ—অনেক সময় শেষ গরুটি বিক্রি করে বা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তারা এই সিদ্ধান্ত নেন। কারণ একটাই: শিক্ষার পর চাকরি চাই।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেও বেকার থাকে, কারণ তাদের মধ্যে বাস্তব ও প্রয়োগযোগ্য দক্ষতার ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মতে, দেশে যুব বেকারত্বের হার ১২.৯%, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। এই ব্যবধান পরিবারগুলোতে মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করছে এবং জাতীয় উৎপাদনশীলতাকেও ব্যাহত করছে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে—জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষা নয়, বরং জীবিকার জন্য উপযোগী ও উৎপাদনশীল শিক্ষার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

কর্মমুখী শিক্ষার ধাপভিত্তিক পরিকল্পনা
ধাপ ১: এসএসসি পরবর্তী সিদ্ধান্ত – প্রাথমিক পর্যায়েই দক্ষতা অর্জন
সব শিশু একইভাবে শেখে না। কেউ যদি পড়াশোনায় দুর্বল হয় এবং পরিবারে অর্থনৈতিক সমস্যা থাকে, তবে তাকে জোর করে ঐতিহ্যগত শিক্ষা পথে ঠেলে না দিয়ে ব্যবহারিক কাজে যুক্ত করা অধিক যুক্তিসঙ্গত।
উদাহরণস্বরূপ:
· দর্জির দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ
· অটোমেকানিক্স শিখে গ্যারেজে কাজ
· ইলেকট্রিক মেরামত শপে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা
· ফার্নিচার তৈরির কাজ
· মোবাইল সার্ভিসিং শেখা
প্রভাব: আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৭২% কারিগরি প্রশিক্ষণই হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষানবিশের মাধ্যমে। এই পেশাগুলোতে ডিগ্রির প্রয়োজন নেই, কিন্তু এগুলো আয়-উপার্জনের পথ খুলে দেয়।
ধাপ ২: কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় গুরুত্ব
যেসব শিক্ষার্থী কিছুটা মেধাবী এবং পরিবারেও কিছুটা আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, তাদের জন্য কারিগরি শিক্ষা সাধারণ কলেজ শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।
সুপারিশকৃত ডিপ্লোমাগুলো:
· প্যারামেডিক্যাল ও ল্যাব টেকনোলজি
· ফার্মেসি সহকারী
· ওয়েব ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট
· বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ও ইনস্টলেশন
· চামড়া প্রযুক্তি
কারণ: এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাত্র ২% কর্মজীবী জনশক্তির কাছে আনুষ্ঠানিক পেশাগত প্রশিক্ষণ আছে, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় এই হার ৫০%-এর বেশি। সুতরাং, টিভেট (TVET) খাতকে শক্তিশালী করা বেকারত্ব হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই ডিপ্লোমা কোর্সগুলোতে ইন্টার্নশিপ ও শিক্ষানবিশের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কারণ, বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে কর্মসংস্থান মিলবে না।

ধাপ ৩: কর্মমুখী অনার্স ডিগ্রি
যদি পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো হয় এবং শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য যোগ্য হয়, তবে তাকে এমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামে ভর্তি করাতে হবে, যা সরাসরি চাকরি বা উদ্যোক্তা হওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
প্রস্তাবিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা:
· সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং
· কৃষি প্রযুক্তি
· ফ্যাশন ডিজাইন ও মার্চেন্ডাইজিং
· কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও রোবটিক্স
· সাইবার সিকিউরিটি
· ডিজিটাল মার্কেটিং
· প্যাথলজি ও রেডিওলজি
· গ্রীন টেকনোলজি ও পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি
তথ্যভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি: লিংকডইনের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা সায়েন্স ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশি তরুণরা এসব দক্ষতা অর্জন করতে পারলে ফ্রিল্যান্সিং ও গ্লোবাল টেক মার্কেটে সহজেই প্রবেশ করতে পারবে, যেখানে উপার্জন স্থানীয় চাকরির চেয়ে অনেক বেশি।
ধর্মীয় শিক্ষার সাথে বাস্তব দক্ষতার সমন্বয়
ধর্ম নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, সহমর্মিতা এবং আত্মিক উদ্দেশ্য তৈরি করে। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ, রোজা, সৎ আচরণ শেখাতে হবে।
কিন্তু বর্তমান যুগে শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। যারা ধর্ম প্রচারের সাথে যুক্ত হতে চান, তাদেরও সম্মানজনকভাবে বাঁচার জন্য আধুনিক দক্ষতা অর্জন জরুরি।
উদাহরণস্বরূপ:
· একজন হাফেজ যদি গ্রাফিক ডিজাইনের জ্ঞান রাখেন, তবে ইসলামিক কনটেন্ট তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় দাওয়াতি কাজ করতে পারেন।
· একজন ইমাম যদি আরবি টাইপিং ও ভিডিও এডিটিং জানেন, তবে অনলাইনে ক্লাস নিতে পারেন এবং ইউটিউব বা ইসলামিক প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় করতে পারেন।
· একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী যদি অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে শেখেন, তবে আন্তর্জাতিকভাবে অনুবাদের কাজ করে উপার্জন করতে পারেন।
দ্বীন ও দুনিয়া—এই দুইয়ের সমন্বয়েই একজন মানুষ পূর্ণতা পায়।
ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি
চাকরির বাজার দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও ডিজিটাল টুলসের কারণে অনেক প্রচলিত পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ম্যাকিন্সে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে ৮০০ মিলিয়ন চাকরি অটোমেশনের কারণে বিলুপ্ত হতে পারে।
নতুন করে বিবেচনার যোগ্য পেশা:
· ডেটা অ্যানালিটিক্স ও বিগ ডেটা
· ব্লকচেইন ডেভেলপমেন্ট
· রোবটিক্স ও মেকাট্রনিক্স
· জলবায়ু ও পরিবেশ বিজ্ঞান
· বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
· ই-কমার্স ও ডিজিটাল সাপ্লাই চেইন
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ভবিষ্যতের উপযোগী করতে হলে স্কুল থেকেই কোডিং, ডিজিটাল লিটারেসি ও উদ্যোক্তা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics)-ভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো আবশ্যক।

উপসংহার: ডিগ্রিধারী নয়, দক্ষ মানবসম্পদ
শুধু ডিগ্রি যথেষ্ট নয়, দক্ষতাই হলো মূল শক্তি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সার্টিফিকেটভিত্তিক নয়, দক্ষতাভিত্তিক করতে হবে।
শিশুরা যেন শুধু পাস করা শিক্ষার্থী না হয়, বরং দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী, সমাজের জন্য উপযোগী একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক, এটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে তারা যেন নিজের আলোয় জ্বলজ্বল করে, একেকজন যেন হীরকখণ্ড হয়ে ওঠে।
আসুন আমরা অঙ্গীকার করি, শিক্ষা হোক জীবনগঠনমূলক, হোক কর্মমুখী, হোক ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত। এই শিক্ষাই গড়ে তুলবে সার্থক ব্যক্তি, স্বাবলম্বী পরিবার, এবং শক্তিশালী জাতি।